প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন

চকরিয়ায় যে শোকের মাতম উঠেছে তা সুদুুর প্রবাসে, আমাদের মত অনেক বাবা-মাকে নিদারুণ বেদনায় বিহ্বল করে দিয়েছে। পাঁচজন স্কুল পড়ুয়া মেধাবী তরুণের জীবনতরী চলতে শুরু না করতেই মাতামুহুরীর চোরাবলিতে এভাবে হারিয়ে যাবে, তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। ফুটবল খেলা, লুকিয়ে নদীতে ও বিলে বড়শী নিয় মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, পাড়ায় দস্যিপনা করে বেড়ানোই হল ওই বয়সের ধর্ম। কিন্তু একটু আনন্দ খুঁজতে গিয়ে তাদের নিজের জীবন বলি দিতে হবে কেনো?

এমন একটা সময় ছিল যখন প্রতি পাড়াতেই থাকতো ছোটোবড় একটি মাঠ। যেখানে আমরা ফুটবল, ক্রিকেট, সাত চারা, ডাংগুলি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলা নিয়ে বিকেল এবং ছুটির দিনগুলোতো হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকতাম। সেই দিন আর নেই, বদলে গেছে সময় । এখন পাড়ার অলি গলি ঘুরেও খুঁজে পাইনা এক চিলতে সবুজ মাঠ। চারিদিক কেবল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ইট-সুরকির দালান। এভাবে জেনে শুনেই যেনো আমরা কেড়ে নিচ্ছি আমাদের সন্তানদের মুখের হাসি, বন্ধ করে দিচ্ছি সুস্থ বিনোদনের পথ। জীবন-মৃত্যু খোদার হাতে। ভাগ্যের লিখন খন্ডাবে সাধ্য কার? তবে খেলাধূলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ থাকলে, ফুটবল খেলার জন্য মাতামুহুরীতে জেগে উঠা নতুন বালুর চরে ওই পাঁচ তরুণকে হয়তো যেতে হতোনা।

ইদানিং সামাজিক মাধ্যমের আগমনে অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা টেবলেট কিংবা মোবাইল ফোনে ভার্চুয়াল খেলা নিয়েই মেতে থাকে। উপরন্তু আশে পাশে কোনো খেলার মাঠ না থাকায় বাবা-মায়েরা যে তাদের ট্যাবলেট থেকে বিছিন্ন করবেন সে পথও নেই। ফলে অনেকে ছেলেবেলাতেই চোখের জ্যোতি হারাচ্ছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কেউ কেউ অর্ন্তজালের ফাঁদে পড়ে বিপদগামী হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে।

আধুনিক নগর পরিকল্পনায় নাগরিকদের বিনোদনের জন্য খোলামাঠ কিংবা পার্কের জন্য জায়গা রাখা হচ্ছে একটি অন্যতম জরুরী শর্ত। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প এই নির্দেশনা মেনেই করতে হয়। যেমন আমেরিকার নগর পরিকল্পনার শর্তানুযায়ী এলাকায় বসবাসকারী প্রতি ১০০০ বাসিন্দাদের জন্য কমপক্ষে ১০ একরের একটি জায়গা পার্কের জন্য রাখতে হবে। আর কোনো বাড়ী থেকে এই খোলা মাঠ, ৪০০ মিটারের বেশী দূরত্বে হতে পারবেনা। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াতেও প্রতি ১০০০ বাসিন্দাদের জন্য একটি পার্ক কিংবা খোলা মাঠ বরাদ্ধ রাখার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। আর কাতার মাস্টার প্ল্যানেও প্রায় একই ধরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশাকরি, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আর্ন্তজাতিক মানদন্ড বিবেচনা করে কক্সবাজার শহরের উপযোগী দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।

আমাদের ছোটোবেলায়, কমবেশী সবাই পাড়া কিংবা গ্রামের পুকুরেই দৌড়ঝাপ দিয়ে এবং কখনো হাবুডুবু খেয়ে সাঁতার শিখে ফেলতো। কিন্তু এখন পুকুরেরও পড়েছে আকাল। পুকুল, জলাশয় ভর্তি করে চলছে রমরমা রিয়েল স্টেট ব্যবসা। বাচ্চারা সাঁতার শিখবে কোথায়? উন্নত দেশের প্রতিটি স্কুলে রয়েছে সুইমিং পুল। সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন থাকে সাঁতার শিক্ষার ক্লাস। এছাড়া রয়েছে সাঁতার শিক্ষার জন্য প্রচুর প্রাইভেট স্কুল। প্রতিটি বাবা-মা ছোটোবলায় স্কুলে কিংবা ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায়, বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে সচেষ্ট থাকেন। সন্তানরা যাতে পানি-ঘটিত কোনো দূর্ঘটনা কিংবা সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে সেজন্য জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা হিসাবে, লেখাপড়ার সাথে সাথে সাঁতার শিক্ষা দেয়াটাও সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। আশাকরি, আমাদের দেশের বাবা মায়েরা সন্তানদের সাঁতার শেখানোর ব্যাপারে আরও সচেষ্ট হবেন।

সাঁতার শেখানোর স্কুল আমাদেরদেশে খুব একটা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমাদের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যদি সাঁতার স্কুল খোলার ব্যবসায় নজর দেন তাহলে আর্থিক লাভের সাথে সাথে পুরো সমাজও উপকৃত হবে।

কোনো কিছু হারানোর পরেই আমাদের ভাবোদয় হয়। চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর দূর্ঘটনার পর, উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উপজেলা কর্তৃপক্ষ। এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। প্রার্থনা করছি খুব শীঘ্রই এর বাস্তবায়ন হবে। আশাকরি, শুধু চকরিয়ায় কেনো? দেশের প্রতিটি উপজেলাতেও এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মনে পড়ে বেশ কিছুদিন আগে, কক্সবাজারের সমুদ্রের জলে একজন ছাত্রের অকাল মৃত্যুর পর পর তার বাবা সৈকতে নিজ খরচে লাইফ গার্ড নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন। কক্সবাজারের মতো আর্ন্তজাতিক সৈকতের বিভিন্ন জনপ্রিয় পয়েন্টে সতর্কতামূলক নির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লাইফ গার্ড থাকা দরকার। দূর্ঘটনার সময় উদ্ধার কার্য চালানোর নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও তাদের সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সচেতনতার জন্য বিলবোর্ড ও টেলিভিশনে বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞাপনও দেয়া যেতে পারে।

যারা চলে গেছে, তাদেরতো ফিরিয়ে আনা যাবেনা। কিন্তু এভাবে অকালে যাতে আর কোনো তরুণের প্রান ঝরে না পড়ে, আর কোনো বাবা-মাকে যাতে নিজ সন্তানের অকাল মৃত্যুর নিদারুণ শোক বহন করতে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায় আমাদের সবার।